December 8, 2024, 5:59 am

বরগুনায় পুলিশে চাকরি পেলেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তরুণীসহ ১৯ জন

তরিকুল ইসলাম রতন, বরগুনা জেলা প্রতিনিধি

বরগুনায় কোন ঘুষ ও তদবির ছাড়া মাত্র ১১৩ টাকা খরচ করে তাদের মেধা ও যোগ্যতায় পুলিশের চাকরি পেলেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তরুনীসহ ১৯ জন ।

খুশিতে কেঁদে ফেললেন অনেকে। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে হতদরিদ্র বাবা-মায়ের।

বরগুনা জেলা পুলিশ লাইনস্ মাঠে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগ কার্যক্রমের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে বুধবার (২৪ নভেম্বর) দিবাগত রাতে ওই ১৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৬ জন পুরুষ এবং নারী ৩ জন।

বরগুনায় এবারের পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি প্রাপ্তদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের কেউ দিনমজুরের সন্তান, কেউ ভ্যান চালকের আবার কেউবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোন মতে পড়াশুনার খরচ চালিয়ে চ‚ড়ান্ত সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে চাকরি হওয়ায় অনেকের চোখেই ছিল আনন্দ অশ্রু।

যার বিপরীতে ঢের প্রশংসা কুড়িয়েছেন বরগুনা জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক। কারণ পুলিশ সুপার মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক এর শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার কারণেই শারীরিক যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতে এখানকার ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে।

জেলার তালতলী উপজেলার কবিরাজপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হতদরিদ্র আংনামং এর মেয়ে লাচানচো। তার স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করার। কিন্তু স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতা মিলছিলোনা। হঠাৎ তিনি জানতে পারলেন পুলিশে চাকরি পেতে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না। আবেদন ফরম পূরণ করে লাইনে দাঁড়ালেন এবং সব বাছাইয়ে মেধা ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়ে কোনো টাকা ছ্ড়াাই পুলিশে নিয়োগ পেলেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির এই তরুণী।

বুধবার (২৪ নভেম্বর) রাতে জেলা পুলিশ লাইন্সে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে রেজাল্ট ঘোষণার পর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তরুণী লাচানচো আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও যেন এই রকমের সুযোগ থাকে, কোনো ঘুষ ছাড়া যেন যোগ্য ও মেধাবীদের চাকরি হয়।

বরগুনা সদর উপজেলার নিশানবাড়িয়া গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. আলী হোসাইনের মেয়ে নুসরাত জাহান মিরু। ছোট বেলা থেকে দারিদ্রতার মাঝে তার বেড়ে ওঠা। তিনি ভেবেছিলেন কোনদিন মনে হয় সরকারি চাকরি কপালে জুটবে না। কিন্তু পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে তার সেই ভাবনার অবসান ঘটলো। মাত্র ১১৩ টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি হয়েছে নুসরাত জাহান মিরুর।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নুসরাত জাহান মিরু বলেন, আমার বাবা একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। আমি ভেবেছিলেন কোনদিন মনে হয় সরকারি চাকরি কপালে জুটবে না। কিন্তু আমার মেধা ও যোগ্যতায় মাত্র ১১৩ টাকায় সরকারি চাকরি পেলাম। সেটাও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে। চাকরির জন্য কোন প্রকার তদবির কিংবা ঘুষ দিতে হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এই তরুণী বলেন, আমি খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমার ঘুষ দেয়ার কোনো সামর্থ্য নেই। আর ঘুষ দেয়া তো দূরের কথা, এমন প্রস্তাবকারীও আমার কাছে আসেনি।

মাত্র তিন টাকার আবেদন ফরম, ১০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট ও চালান ১০ টাকাসহ মোট ১১৩ টাকা খরচ করে মেধা ও যোগ্যতায় পুলিশে চাকরি পেয়ে নিজের অনুভ‚তি প্রকাশ করে মো. টিপু নামে এক তরুণ বলেন, আমার বাবা একজন ভ্যান চালক। অনেক কষ্ট করে দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে এই পর্যন্ত এসেছি। আমার নিজের যোগ্যতায় নিয়োগ কার্যক্রমের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে আমি চ‚ড়ান্ত হয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত সদস্য হতে পেরেছি। দেশের জন্য নিজের জীবনবাজি রাখবো।

দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্যই কাজ করতে চাই জানিয়ে সদর উপজেলার কুমড়াখালী গ্রামের মোস্তফা কামালের মেয়ে মার্জিয়া আক্তার শামু বলেন, ছোট বেলা থেকেই গল্প শুনেছি টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি হয় না। কিন্তু সেই পুলিশ বদলে যাচ্ছে। আমরা এ বদলে যাওয়ার যুগের অগ্নিসাক্ষী।

শুধু নুসরাত জাহান মিরু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তরুণী লাচানচো ও টিপু নয়, তাদের মতোই মোট ১৯ জন তরুণ-তরুণী নিজেদের মেধা ও যোগ্যতায় মাত্র ১১৩ টাকায় পুলিশে চাকরি পেয়েছেন।

জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বরগুনা জেলায় পুলিশের ১৯ জন কনস্টেবল নিয়োগে সরকার কর্তৃক জারীকৃত বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি (সাধারণ, মুক্তিযোদ্ধা, আনসার ও ভিডিপি, এতিম, পোষ্য এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা) অনুসরণ করে গত ১৪ ও ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৭৬০ জন চাকরি প্রার্থী প্রাথমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। শারীরিক যাচাই-বাছাইয়ের পর ৩ দিনব্যাপী শারীরিক সক্ষমতা অর্জন, লিখিত এবং মনস্তাত্তি¡ক ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় কোন তদবীর-সুপারিশ ব্যতিত ১৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক।

জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক জানান, এই জেলায় ১৬ জন পুরুষ ও ৩ জন নারীসহ মোট ১৯ জনকে কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শারীরিক যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে অত্যন্ত স্বচ্ছতা-নিরপেক্ষতার সঙ্গে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ নজিরবিহীন ঘটনা।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আইজিপির শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে এ নিয়োগ সম্পন্ন করার জন্য কড়া নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আমরা পেশাদারিত্ব, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুকে আমরা