আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ফোনালাপ ফাঁস ও অনিয়মের অভিযোগে বরগুনার তালতলী উপজেলার বগীরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) সকালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি আবুল কালাম নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করেন। এ নিয়োগে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইদ্রিসুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দেলোয়ার সিকদারের বিরুদ্ধে মোটা অংকের ঘুস নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ৮ আগস্ট বগীরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নৈশপ্রহরী ও অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ওই বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক তিনটি পদে ২৪ জন প্রার্থী আবেদন করেন।
রোববার বরগুনা জেলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কক্ষে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শনিবার (২৮ জানুয়ারি) রাতেই নিয়োগ পরীক্ষায় নৈশপ্রহরী পদে অর্থ লেনদেনের ফোনালাপ ফাঁস হয়। এ ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পরপরই নিয়োগ কমিটির সদস্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি আবুল কালাম পরীক্ষা স্থগিত করেন।
ফোনালাপে পুরুষ কণ্ঠে এক ব্যক্তি বলেন, তুমি তাড়াতাড়ি টাকা দাও। অনেক প্রার্থী রয়েছে। এসময় আঙ্কেল সম্বোধন করে নারী কণ্ঠে একজন বলেন, চাকরি হবে তো? প্রতিউত্তরে তিনি (পুরুষ) বলেন, এ নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। কেউ নিয়োগ ঠেকাতে পারবে না। নারী বলেন, আঙ্কেল, আমি তো নগদ টাকা দিতে পারবো না, চেক দিতে হবে। এর প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, আমি চেক নিতে পারবো না, আমি ব্যস্ত আছি। ওই চেক নিয়ে ব্যাংকে যাওয়ার সময় নেই। আরেক ফোনালাপে চুক্তি অনুসারে টাকা দিতে চাপ দিতে শোনা যায় ওই ব্যক্তিকে। তিনি বলেন, টাকা না দিলে কী হয় বলা যাবে না? প্রধান শিক্ষকেরও টাকার প্রয়োজন আছে বলে জানান ওই ব্যক্তি। অডিওর ওই পুরুষ ব্যক্তি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দেলোয়ার সিকদার বলে জানা গেছে। এভাবে চারটি অডিওতে তার কথোপোকথন শোনা গেছে। এ নিয়োগ পরীক্ষায় সভাপতি দেলোয়ার সিকদার ও প্রধান শিক্ষক ইদ্রিসুর রহমানের বিরুদ্ধে তিনটি পদের বিপরীতে ৭-৮ জনের কাছ থেকে ৬-৭ লাখ টাকা ঘুস নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, অফিস সহায়ক পদে ইনামুল হক, নৈশপ্রহরী পদে বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী বশির ফকিরের ভাইয়ের ছেলে আতিকুর রহমান এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে অনিমা রানীকে নিয়োগ দিতে জোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক।
নৈশপ্রহরী পদে আবেদনকারী রিপন দাসের বোন দুলি রানী বলেন, ‘আমার বাবা ওই বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী পদে চাকরি করতেন। ২০১০ সালে বাবা স্ট্রোক করে মারা যান। বাবার পরিবর্তে আমার ভাইকে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। ওই নিয়োগ বাবদ সভাপতি দেলোয়ার সিকদার আমার কাছ থেকে গত বছরের জানুয়ারিতে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন। এখন বলছেন নিয়োগ নিতে হলে আরও চার লাখ টাকা লাগবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক আমার ভাইয়ের পরিবর্তে আতিকুর রহমান নামের একজনের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে তাকে নিয়োগ দেবেন বলে চুক্তি করেছেন। এখন তিনি (সভাপতি) আমার টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করছেন।’ পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে অঞ্জু নামের এক আবেদনকারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সভাপতি দেলোয়ার সিকদার ও প্রধান শিক্ষক ইদ্রিসুর রহমান চাকরি দেবেন বলে আমার কাছে ৮ লাখ টাকা দাবি করেছেন। কিন্তু আমি এত টাকা দিতে রাজি হইনি। সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগের নামে অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। সভাপতি আমার এক আত্মীয় রিপনের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন।’
আরও পড়ুন- কাভার্ডভ্যানের চাপায় 2 মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইদ্রিসুর রহমান একাত্তরবিডিটুয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘কার্ড ইস্যু নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে তাই ডিজির প্রতিনিধি নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। আর আমি কারও কাছ থেকে টাকা নেইনি।’ সভাপতির ফোনালাপের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমিও শুনেছি সভাপতি ফোনে কার কাছে টাকা চেয়েছেন।’ এ বিষয়ে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দেলোয়ার সিকদার বলেন, আমি কারও কাছে টাকা চাইনি এবং নেইনি। ফোনালাপের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, এগুলো মিথ্যা।
তালতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর কবির বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি আমাকে জানিয়েছে। কী কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে তা আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম বলেন, যথাযথ নিয়মে নিয়োগ কার্ড ইস্যু করা হয়নি। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মিলে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে গড়ে ৭-৮ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। নৈশপ্রহরী পদে এক মুচির ছেলের কাছ থেকেও তারা টাকা নিয়েছেন বলে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক।’ তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম সাদিক তানভীর বলেন, বিষয়টি জেনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।