বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের সহযোগিতায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা স্যাপ-বাংলাদেশ ও আভাস এর গলাচিপা উপজেলার ৮৮জন নারীকে নিয়ে গঠন করা ‘লাক কেন্দ্র’ নামের সংগঠনটির বিকল্প কর্মসংস্থানের একমাত্র আয়ের পথটি থমকে গেছে। এসময় সংস্থাটির আর্থিক সহায়তায় দুটি স্পীডবোট কিনে দেওয়া হলেও সঠিক তদারকি না করার কারণে সংগঠনটির একটি স্পীডবোট চুরি হয়ে যায় এবং আরেকটি স্পীডবোটের ইঞ্জিনও রহস্যজনকভাবে চুরি হয়ে যায়। ফলে হতাশায় দিন কাটছে ওই ৮৮জন নারী সদস্যের। এরই মধ্যে আভাস এর প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেছে। সদস্যদের মধ্যে নেই কোন ঐক্য। তাই নতুন করে সদস্যদের মধ্যে থেকে চাঁদা তুলে স্পীডবোট কেনা সম্ভব হচ্ছেনা। এখন লোক কেন্দ্রের স্পীডবোট দুটি শুধুই স্মৃতি। স্পীডবোট ড্রাইভার ও পরিচালনা কমিটির এক সদস্যের বিরোধের কারণে সফলতা হাত ফসকে গেছে বলে মনে করেন সাধারণ সদস্যরা। তবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে আবারও সফলতা পাবে বলে মনে করেন বেসরকরি সংস্থা আভাস এর সাবেক প্রজেক্ট ম্যানেজার (প্রমোটিং রাইট ফর দ্য চরডুয়েলার্স) মো. ফরিদ উদ্দিন। সরেজমিনে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আভাস সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছর আগে বেসরকারি অ্যাকশন এইড এর সহায়তায় প্রথমে বাস্তবায়নকারী সংস্থা স্যাপ বাংলাদেশ ও পরে আভাস উপকূলীয় গলাচিপা উপজেলার চরবিশ্বাস ও চরকাজল ইউনিয়নের নারীদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে। এর ধারাবাহিকতায় নারীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের আয়ের পথ হিসেবে ৯জন নারী সদস্যকে স্পীডবোট ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এসময় ৮৮জন নারীকে নিয়ে গঠন করা হয় ‘লোক কেন্দ্র’ নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনটি তাদের সঞ্চয় ও এককালিন চাঁদার টাকা দিয়ে স্পীডবোট কিনে ভাড়ায় চালানো শুরু করে। এসব স্পীডবোটের ড্রাইভার হিসেবে রয়েছে সদস্যদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী ড্রাইভার। যা এলাকায় সকলের কাছে ভিন্নভাবে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। ভাড়ায় চালিত স্পীডবোটে প্রথম দেড় বছরে লাভ হয়েছে। যার টাকা দিয়ে আরও একটি ১৬ সিটের নতুন স্পীডবোট সংগঠনটি ক্রয় করে। কিন্তু এরই মধ্যে আভাস এর প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে সকল মালামাল সংগঠনটির সভাপতি ও সম্পাদকসহ সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর মাত্র চার মাস পরেই স্থানীয় প্রভাবশালী এক পুরুষ ড্রাইভারের উদাসীনতায় লোকসান গুনতে হচ্ছে লোক কেন্দ্রের একমাত্র আয়ের উৎস স্পীডবোট ভাড়া। এক পর্যায় সদস্যদের অভ্যন্তরিণ কোন্দল আর বিআইডবিøউটিএ’র অসহযোগিতায় থেমে যায় নারীদের বিকল্প আয়ের একমাত্র পথটি। আর এ সুযোগে লোক কেন্দ্রের নিজস্ব সম্পত্তি দুটি স্পীডবোটের একটি চুরি হয়ে যায় এবং আরেকটি পরিত্যক্ত অবস্থায় নদীর ঘাটে বাঁধা ছিল। পরবর্তীতে যারা তদারকির দায়িত্বে ছিলেন তাদের অবহেলা ও উদাসীনতায় ওই পরিত্যক্ত স্পীডবোটটির ইঞ্জিনও রহস্যজনকভাবে চুরি হয়ে যায়। মেশিনটি চুরি হওয়ার দীর্ঘ প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেলেও থানায় সাধারণ ডায়েরি বা মামলা করেনি লোক কেন্দ্রের সভাপতি-সম্পাদক। আর তাদের এ রহস্যজনক আচরণের কারণেই সাধারণ সদস্যদের অভিযোগ থেকেই যাচ্ছে। থানার অভিযোগের বিষয়টি সম্পর্কে লোক কেন্দ্রের সভানেত্রী মাহামুদা পারুল চরকাজল পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে একটি অভিযোগ করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন সদস্যদের একজন। এর কিছুদিন পর গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জের সাথে কথা বলেও অভিযোগ বা জিডির কোন কপি পাননি সংগঠনটির সভানেত্রী। তাই অভিযোগটি কি অবস্থায় আছে তাও জানতে পারেননি তিনি।
দক্ষিণ চরবিশ্বাসের নারী স্পীডবোট ড্রাইভার খাদিজা বেগম বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর অভাবের সংসারে ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা ও সংসার খরচ চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। ড্রাইভার প্রশিক্ষণের পর দেড় বছর সংসার ভালই চলছিল। কিন্তু মেশিন চুরি হওয়ার পর আমি বেকার হয়ে গেছি। এখন গ্রামের পানের বরজের মাটির কাজ করে সামান্য টাকা আয় হয়। তা দিয়ে কোন রকম ছেলে মেয়ের পড়াশুনার খরচ ও সংসার চালাই।
অপর আরেক নারী ড্রাইভার কুলসুম বলেন, আমি যখন ড্রাইভার ট্রেনিং করে ঘাটে স্পীডবোট নিয়ে গেছি তখন ঘাটের পুরুষরা আমাকে ‘বেশ্যা’ বলতেও দ্বিধা করে নাই। কিন্তু এতসব কথা শুনেও আমি থেমে থাকি নাই। সংসারের আয়ের জন্য উত্তাল নদী পারি দিয়েছি। কিন্তু আমাদের উন্নতি চোখে সয়নি এ সমাজের কিছু মানুষের। তাই তো আমাদের আয়ের পথকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আমাদের সমিতির বোট ও বোটের মেশিন চুরি করে নিয়া গেছে। পুলিশও উদ্ধার করার কোন চেষ্টা করছে না। আমি এখন বাজারে বাজারে কাম (কাজ) করি। প্রতিদিন তিন শ টাহার মতো পাই। কিন্তু এ দিয়ে সংসার চলে না। কথাগুলো বলে অঝোরে কেঁদেছেন কুলসুম। পরে তিনি আরও বলেন, আমরা আশায় আছি নতুন করে বোট কিনে আবার উত্তাল নদী পারি দিবো।
স্পীডবোটটির পুরুষ ড্রাইভার ইলিয়াস বলেন, আমি যদতিন তদারকি করেছি কোন ক্ষতি হতে দেইনি। চুরি হওয়ার পর আমি সভানেত্রীর সাথে পুলিশসহ বিভিন্ন জায়গায় দেন দরবার করেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত বোট ও বোটের মেশিনের হদিস পাইনি।
এ বিষয়য়ে লোক কেন্দ্রের সভানেত্রী মাহামুদা পারুল বলেন, আমি সংগঠনটির সভানেত্রী হওয়ার আগেই একটি স্পীডবোট চুরি হয়ে যায় এবং আরেকটি ঘাটে বাঁধা ছিল। কিন্তু আমার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মাথায় ঘাটে বাঁধাওই বোটের মেশিন চুরি হয়ে গেছে। আমি পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা দিতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, সমিতির সভানেত্রী হওয়ার পর দেখছি, এখানের সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত। তাই সঞ্চয় টাকা আদায় বা উত্তোলণ করাও সম্ভব হচ্ছে না। অথচ সংগঠনটি এগিয়ে নিতে পারলে এ অঞ্চলের নারীদেরই উন্নয়ন হতো।
এ বিয়য়ে বেসরকরি সংস্থা আভাস এর সাবেক প্রজেক্ট ম্যানেজার (প্রমোটিং রাইট ফর দ্য চরডুয়েলার্স) মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, গত ডিসেম্বর মাসের দিকে আভাসের প্রজেক্ট শেষ হয়ে যায়। তাই ওই সময় লোক কেন্দ্রের সকল হিসাব নিকাশ আমরা সংগঠনটির সভানেত্রীর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আসি। এরকম একটা চলমান সংগঠন স্বার্থান্বেসী একটি মহলের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটা শুনে খুব খারাপ লাগছে।
এ প্রসঙ্গে গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এমআর শওকত আনোয়ার ইসলাম বলেন, স্পীডবোটের বিষয় আমার কাছে কোন অভিযোগ আসেনি। তবে ওই সমিতির অভ্যন্তরিণ কোন্দলের কারণে চুরির ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ধারণা করছি পুরুষ কোন ড্রাইভার এর সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। তবে তদন্ত করে তা স্পষ্ট বলা সম্ভব হবে।